তারাবির নামাজ কত রাকাত
পবিত্র মাহে রমজান আনন্দময় ইবাদতের সময়। রমজানে মুমিনের জন্য একটি বিশেষ নামাজের বিধান দেওয়া হয়েছে। বছরের আর কোনো মাসে এই নামাজ পড়ার বিধান নেই। বিশেষ এই নামাজের নাম ‘তারাবি’। তারাবি আরবি শব্দ ‘তারবিহাতুন’-এর বহুবচন। এর অর্থ হলো- আরাম করা ও বিশ্রাম করা।
ইসলামি ফিকহ অনুযায়ী, তারাবির নামাজে প্রতি চার রাকাত পর পর কিছুক্ষণ বসে বিশ্রাম নেওয়ার বিধান রয়েছে। তাই এ নামাজকে তারাবির বা প্রশান্তির নামাজ বলা হয়।
তারাবির নামাজের রাকাত
তারাবির নামাজ ২০ রাকাত। তারাবির নামাজকে আট রাকাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলা অনুচিত। পবিত্র রমজান মাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আমল এই তারাবির নামাজ। এটি সুন্নাতে মুয়াক্কাদা। আল্লাহর রাসুল (সা.) তিন দিন এই নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করেছেন। তিনি নিয়মিত সম্মিলিতভাবে জামাতের সঙ্গে তারাবি নামাজ আদায় করলে, তা ফরজ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। তাই পুরো রমজানে তিনি জামাতের সঙ্গে তারাবির নামাজ আদায় করেননি।
নিয়মতান্ত্রিকভাবে তারাবির নামাজ পড়ার প্রচলন ঘটে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা উমর (রা.)-এর যুগে। সাহাবায়ে কিরামের ঐকমত্যের ভিত্তিতে তা সুন্নাত হিসেবে সাব্যস্ত হয়। তখন আর এটি ফরজ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। কেননা মহানবী (সা.)-এর ওফাতের মাধ্যমে ওহির পথ বন্ধ হয়ে যায়।
তাবেঈ ইবনে আবি জুবাব (রহ.) বলেন, ‘ওমর (রা.)-এর যুগে রমজানের তারাবি ছিল ২৩ রাকাত।’ (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস : ৭৭৩৩)
প্রখ্যাত তাবেঈ আবদুল আজিজ ইবনে রুফাই (রহ.) বলেন, ‘উবাই ইবনে কাব (রা.) রমজানে মদিনায় লোকদের নিয়ে ২০ রাকাত তারাবি ও তিন রাকাত বিতর পড়তেন।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা : হাদিস : ৭৭৬৬)
পৃথিবীর প্রথম সহিহ হাদিসগ্রন্থ ‘মুয়াত্তা মালিক’সহ অন্যান্য কিতাবে উল্লেখ রয়েছে, তাবেঈ ইয়াজিদ ইবনে রুমান (রহ.) বলেন, ‘উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর যুগে লোকেরা রমজানে ২৩ রাকাত তারাবি পড়তেন।’ (মুয়াত্তা মালিক, হাদিস : ৩৮০; আসসুনানুল কুবরা, বায়হাকি, হাদিস : ৪২৪৯)
এ ধরনের বহু সহিহ বর্ণনার আলোকে ও সাহাবি-তাবেয়িনের যুগ থেকে চলে আসা অবিচ্ছিন্ন কর্মের ভিত্তিতে প্রমাণিত হয়, উমর (রা.)-এর যুগে মসজিদ-ই-নববীতে ২০ রাকাত তারাবি হতো। এখনো মক্কা-মদিনায় ২০ রাকাত তারাবি হয়। সারা বিশ্বের মুসলমানরা এই সুন্নাত নামাজে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেন। বলা যায়, এটি সাহাবায়ে কেরামের সুন্নাত।
রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমার ও আমার খুলাফায়ে রাশেদার সুন্নত দৃঢ়ভাবে ধারণ করা তোমাদের জন্য অপরিহার্য।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৪৬০৭, তিরমিজি, হাদিস : ২৬৭৬, মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ১৬৬৯২, সুনানে ইবনে মাজা, হাদিস : ৪২)
সুতরাং তারাবির রাকাত নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই। কেননা যেখানে আট রাকাতের কথা আছে, সেটি মূলত তাহাজ্জুদসংক্রান্ত হাদিস। মহানবী (সা.) রমজানে ও রমজানের বাইরে প্রতি রাতে আট রাকাত তাহাজ্জুদ ও তিন রাকাত বিতরের নামাজ পড়তেন। মহান আল্লাহ আমাদের উপলব্ধি ও আমল করার তাওফিক দান করুন।
বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম; তারাবির নামাজ কত রাকাত: আজকে তারাবির রাকাত সংখ্যা নিয়ে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ। যেহেতু এই মর্মে অনেক মতভেদ আলেমদের মাঝে দেখা যায়। আজকের আলোচনা থেকে আপনারা সহজেই এই মর্মে স্পষ্ট ধারণা পাবেন ইনশাআল্লাহ।
৮ রাকাত তারাবির অকাট্য প্রমাণ
আবু সালামা ইবনে আবদুর রহমান (রাঃ) বলেন,
তিনি একদা আয়েশা (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করেন যে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর রমজানের রাতের সালাত কেমন ছিল। উত্তরে তিনি বলেন, রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রামাযান মাসে এবং রামাযানের বাইরে ১১ রাকাতের বেশি ছালাত আদায় করতেন না। তিনি প্রথমে (২+২) চার রাকাত পড়তেন। তুমি (আবু সালামা) তার সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করাে না। অতঃপর তিনি (২+২) চার রাকাত পড়তেন। তুমি তার সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করাে না। অতঃপর তিনি তিন রাকাত (বিতর) পড়তেন।
সহীহ মুসলিম ২০১৩
হাদীছটি প্রায় সকল হাদীস গ্রন্থেই বর্ণিত হয়েছে। এর বিশুদ্ধতা সম্পর্কে আলোচনার প্রশ্নই উঠে না। কারণ ইমাম বুখারী (১৯৪-২৫৬ হিঃ) ও মুসলিম (২০৪-২৬১ হিঃ) স্ব স্ব সহীহ গ্রন্থে এটি বর্ণনা করেছেন। বিশেষ করে ইমাম বুখারী (রহঃ) হাদীছটি তারাবীর সালাত অধ্যায়ে বর্ণনা করেছেন। তিনি রামাযান ও অন্য মাসে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর রাত্রির সালাত অধ্যায়েও হাদীসটি উল্লেখ করেছেন। এছাড়াও অন্য আরেকটি অধ্যায়ে ভিন্ন সনদে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন।
উল্লেখ্য যে, ইমাম বুখারী (রহঃ) উক্ত শিরোনাম উল্লেখ করলেও ভারত উপমহাদেশের ছাপা সহীহ বুখারী থেকে তা মুছে দেওয়া হয়েছে। কারণ হল, তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ পৃথক সালাত, তারাবীহ ২০ রাকাত আর তাহাজ্জুদ ১১ রাকাত, আয়েশা (রাঃ)-এর হাদীসে তাহাজ্জুদের কথা বলা হয়েছে ইত্যাদি যে সমস্ত মিথ্যা কথা প্রচলিত আছে উক্ত শিরোনামের মাধ্যমে সেগুলো ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়েছে। এছাড়া উপমহাদেশে ছহীহ বুখারীর পাঠদান ও পাঠগ্রহণকারী লক্ষ লক্ষ শিক্ষক-ছাত্র ও ওলামায়ে কেরামের নিকট বিষয়টি যখন পরিস্কার হয়ে যাবে, তখন তাদের মনে চিরতরে বদ্ধমূল হয়ে যাবে যে, তারাবীহর
ছালাত ৮ রাকআত; ২০ রাকআত নয়।
কারণ তখন ইমাম বুখারীর উপরে অন্য কোন ব্যক্তির প্রাধান্য থাকবে না। তাই এই ন্যক্কারজনক কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে। আমরা দৃঢ় বিশ্বাস করি যে, ছল-চাতুরী করে ইসলামী শরীআতকে কখনাে গােপন করা যায় না। ছহীহ বুখারী শুধু উপমহাদেশেই ছাপা হয় না; বরং বিশ্বের বহু দেশে আল্লাহ তাআলা তা ছাপানাের ব্যবস্থা রেখেছেন। তাই সিরিয়া, মিসর, কুয়েত, লেবানন, সউদী আরবসহ অন্যান্য দেশে ছহীহ বুখারী যত বার ছাপানাে হয়েছে সেখানেই উক্ত শিরােনাম বহাল রয়েছে, তা পুরাতন হােক আর নতুন হােক। আফসােস! হককে গোপন করার এই কৌশলী ব্যবসা আর কত দিন চলবে! উক্ত হাদিস থেকে স্পষ্ট ভাবে প্রমাণিত হয় যে, রামাযান মাসে হোক আর অন্য মাসে হােক রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রাত্রির সালাত ১১ রাকাতের বেশি কখনাে পড়তেন না। যার মধ্যে আট রাকাত তারাবীহ বা তাহাজ্জুদ আর তিন রাকাত বিতর ।
আরো প্রমাণিত হল যে, তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ একই সালাত, ভিন্ন কোন সালাত নয়। তাই ইমাম বুখারী হাদীছটি ‘তাহাজ্জুদ’ সালাতের অধ্যায়েও বর্ণনা করেছেন। উক্ত হাদীছের বিশুদ্ধতা সম্পর্কে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলা যায় যে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর রাত্রির সালাত অর্থাৎ তারাবীহ ও তাহাজ্জুদের রাকাত সংখ্যার ব্যাপারে এর চেয়ে অধিক বিশুদ্ধ হাদীস পৃথিবীতে আর নেই। এছাড়া আয়েশা (রাঃ)-কে আবু সালামা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর রমজান মাসের রাতের সালাত সম্পর্কেই জিজ্ঞেস করেছিলেন। আর তারই জবাবে তিনি ১১ রাকাতের কথা উল্লেখ করেন।
আরো স্পষ্ট হয় যে, হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে মা আয়েশা (রাঃ)-এর মাধ্যমে। আর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর রাত্রির অবস্থা সম্পর্কে অন্যদের চেয়ে তিনিই বেশি জানবেন এটাই স্বাভাবিক। অতএব দ্বীনের প্রকৃত অনুসারীদের জন্য এই একটি হাদীস ই যথেষ্ট।
জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ রাঃ বলেন,
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রমজান মাসে আমাদের সাথে ৮ রাকআত সালাত আদায় করেছেন এবং বিতর পড়েছেন।
সহীহ ইবনে খুযায়মাহ ১০৭০
হাদীছটি কয়েকটি সূত্রে হাসান সনদে বর্ণিত হয়েছে; আল্লামা যাহাবী (৬৭৩-৭৪৮ হিঃ) তার মীযানুল ইতিদাল গ্রন্থে হাদীসটি উল্লেখ করার পর বলেন, হাদিসটির সনদ উত্তম স্তরের অর্থাৎ হাসান; শায়খ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ) বলেন, হাদিসটির সনদ হাসান; ইবনে খুযায়মার মুহাক্কিক ড. মুহাম্মাদ মুস্তাফা আল আজামী বলেন, এর সনদ হাসান; উল্লেখ্য, হাদীসটিকে কেউ কেউ ত্রুটিপূর্ণ বলতে চাইলেও তা সঠিক নয়; কারণ ইমাম যাহাবী এর সম্পর্কে হাসান বলে মন্তব্য করেছেন; তাই সাধারণত অন্যের মন্তব্যের অপেক্ষা রাখে না।
সরাসরি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পক্ষ থেকে মারফু সূত্রে বর্ণিত উপরিউক্ত ছহীহ হাদীছ সমূহের মাধ্যমে অকাট্য ভাবে প্রমাণিত হল যে, তারাবীহর সালাত ৮ রাকাতের বেশি নয়।
তাই শায়খ আলবানী উক্ত দলিল সমূহ পেশ করার পর বলেন,
যা পূর্বে উল্লিখিত হয়েছে তাতে আমাদের নিকট স্পষ্ট হয়েছে যে, রাত্রির সালাতের রাকাত সংখ্যা হল ১১, যা রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আমল থেকে সহীহ দলিলের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে।
সুতরাং উম্মতে মুহাম্মদীর উপর অপরিহার্য কর্তব্য হল, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর এই সুন্নাতকে শক্ত ভাবে হাতে দাঁতে আঁকড়ে ধরা। কারণ তিনি কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিলে সে বিষয়ে মুসলিম নর-নারীর স্বেচ্ছা প্রণোদিত হয়ে কিছু করার অধিকার থাকে না।
যদি কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সিদ্ধান্তের বাইরে যায় তাহলে তার পরিণতি হবে অত্যন্ত ভয়াবহ।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিলে কোন মুমিন পুরুষ বা কোন মুমিন নারীর সে বিষয়ে ভিন্ন সিদ্ধান্তের অধিকার থাকে না; যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অমান্য করবে সে স্পষ্টই পথভ্রষ্ট হবে।
সূরা আহযাব আয়াত নং ৩৬
অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন,
আপনার প্রতিপালকের শপথ! তারা মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের বিবাদ-বিসম্বাদের বিচার ভার আপনার উপর অর্পণ না করবে; অতঃপর আপনার দেওয়া সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে তাদের মনে কোন দ্বিধা থাকবে না এবং সর্বান্তকরণে মেনে নেবে।
সূরা আন নিসা আয়াত নং ৬৫
এছাড়া আরো নির্দিষ্ট করে বলা হয়েছে যে, কোন বিষয়ে মতানৈক্য দেখা দিলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সিদ্ধান্তের দিকে ফিরে যেতে হবে।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর এবং তোমাদের মধ্যে যিনি শাসক তার; তোমাদের মাঝে কোন বিষয়ে মতভেদ হলে সেটাকে আল্লাহ ও রাসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও; যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাক; এটাই কল্যাণকর ও পরিণতির দিক থেকে উত্তম।
সূরা আন নিসা আয়াত নং ৫৯
উক্ত দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা সত্ত্বেও যদি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সুন্নাতের বিরোধিতা করা হয় তাহলে ইহকালে ও পরকালে এর পরিণতি হবে অত্যন্ত মর্মান্তিক।
মহান আল্লাহ বলেন,
অতএব যারা রাসূলের আদেশের বিরুদ্ধাচারণ করে তারা এ বিষয়ে সতর্ক হােক যে, তাদেরকে মহা বিপর্যয় পাকড়াও করবে (দুনিয়াতে) অথবা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি তাদেরকে গ্রাস করবে।
সূরা আন নূর আয়াত নং ৬৩
মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আদর্শের বিরােধী হওয়ার কারণেই আজ বিশ্বব্যাপী মুসলিম উম্মাহর এই মহা বিপর্যয়। তাদের পরকাল হবে আরো ভয়াবহ।
সাহাবীদের যুগে তারাবীহর সালাত
মুসলিম সমাজে প্রচার করা হয় যে, ওমর ও আলী (রাঃ) উভয়েই বিশ (২০) রাকাত তারাবি চালু করেছিলেন; এটা একটা ডাহা মিথ্যা কথা; মর্যাদাশীল জান্নাতি সাহাবীগণের বিরুদ্ধে এগুলো মিথ্যা অপবাদ মাত্র; কারণ তারা কখনো রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আমলের বিপরীতে ২০ রাকাত তারাবীহ পড়েননি, নির্দেশও দেননি; নিম্নে এ বিষয়ে আলোকপাত করা হলঃ
সায়িব ইবনু ইয়াযীদ (রাঃ) হতে বর্ণিত,
তিনি বলেন, ওমর (রাঃ) উবাই ইবনে কা’ব ও তামীম আদ-দারী (রাঃ)-কে লােকদেরকে নিয়ে ১১ রাকাত সালাত আদায় করার নির্দেশ প্রদান করেন।
মুয়াত্তা মালেক ১/১১৫ পৃঃ, রামাযান মাসে রাত্রির সালাত’ অনুচ্ছেদ; সহীহ ইবনে খুযায়মা ৪/৬৯৮ পৃঃ; সাঈদ ইবনু মানসূর, আস-সুনান; কিয়ামুল লাইল, পৃঃ ৯১; আবু বকর আন-নিশাপুরী, আল ফাওয়ায়েদ ১/১৩৫ পৃঃ; বায়হাকী আল-মারেফা; ফির ইয়াবী ১/৭৬ পৃঃ ও ২/৭৫ পৃঃ; আলবানী, তাহক্বীক্ব মিশকাত (বৈরূত: আল-মাকতাবুল ইসলামী, ১৯৮৫/১৪০৫), ১/৪০৭ পৃঃ হা/১৩০২-এর টীকা সহ দ্রঃ; বঙ্গানুবাদ মিশকাত, ৩/১৫২ পৃঃ, হা/১২২৮ রমজানের রাতের সালাত অনুচ্ছেদ।
উপরিউক্ত হাদীছটি অনেকগুলো হাদিস গ্রন্থে বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হয়েছে তার সবগুলােই সহীহ।
আল্লামা নীমভী হানাফী (রহঃ) তাঁর আছারুস সুনান গ্রন্থে হাদিসটির সনদ সম্পর্কে বলেন, এই হাদীসের সনদ ছহীহ।
শায়খ আলবানী বলেন, এই হাদীসের সনদ অতীব বিশুদ্ধ; কারণ সায়িব ইবনু ইয়াযীদ একজন সাহাবী, তিনি ছােটতে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে হজ্জ করেছেন।
অন্যত্র তিনি বলেন, আমি বলছি, এই হাদীসের সনদ অত্যন্ত ছহীহ; কেননা এর রাবী মুহাম্মাদ ইবনে ইউসুফ ইমাম মালেক (রহঃ)-এর উস্তাদ; সকলের ঐকমত্যে তিনি একজন অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য রাবী; তাছাড়া ইমাম বুখারী ও মুসলিম তার হাদীস থেকে দলীল গ্রহণ করেছেন।
উল্লেখ্য যে, মুয়াত্তার ভাষ্যকার আল্লামা যারকানী ইবনু আব্দিল বার-এর বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন যে, ইমাম মালেক ছাড়া অন্যরা কেউ ১১ রাকাতের কথা বর্ণনা করেননি; বরং সবাই ২১ রাকাত বর্ণনা করেছেন, যা মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাকে বর্ণিত হয়েছে; অবশ্য পরেই তিনি এই বক্তব্যের প্রতিবাদ করেছেন; ২১ রাকাত সংক্রান্ত উক্ত বক্তব্য চরম বিভ্রান্তির; কারণ ইমাম মালেক ছাড়াও অনেকেই ১১ রাকাতের উক্ত হাদীস বর্ণনা করেছেন; আবু বকর নিশাপুরী, ফিরইয়াবী, বায়হাক্বী, ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ আল-ক্বাত্বান,২৪ ইসমাঈল ইবনে উমাইয়া, উসামা ইবনে যায়েদ, মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক, ইসমাইল ইবনে জাফর প্রমুখ ওমর (রাঃ) নির্দেশিত ১১ রাকাতের হাদীস বর্ণনা করেছেন।
আব্দুর রহমান মুবারকপুরী উক্ত বক্তব্যের বিরুদ্ধে বলেন,
আমি বলছি, ১১ রাকাত ত্রুটিপূর্ণ’ ইবনে আব্দুল বার-এর এই বক্তব্য আমার নিকট অতীব ভ্রান্তিপূর্ণ।
শায়খ আল্লামা ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী (মৃঃ ১৯৯৪ খৃঃ) তার মিশকাতুল মাসাবীহ-এর জগদ্বিখ্যাত ভাষ্য ‘মিরআতুল মাফাতীহ’ গ্রন্থে উক্ত হাদীসের আলোচনায় বলেন,
ওমর (রাঃ) রমজানের রাতের সালাতের জন্য লােকদেরকে যে একত্রিত করেছিলেন এবং তিনি যে তাদেরকে বিতর সহ ১১ রাকাত করে পড়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন, এই হাদীস তার প্রামাণ্য দলীল। এছাড়া তার যুগে সকল সাহাবা ও তাবেয়ীগণ যে তারাবীর সালাত ১১ রাকআতই পড়তেন এটা তারও সুস্পষ্ট প্রমাণ। কারণ এ হাদীছটি পূর্বে বর্ণিত আয়েশা (রাঃ)-এর হাদীসের সাথে পুরোপুরি সামঞ্জস্যশীল এবং জাবির (রাঃ) বর্ণিত হাদীসের সাথেও সামঞ্জস্যশীল।
মুহাম্মদ ইবনু ইউসুফ রাঃ বলেন, সায়িব ইবনু ইয়াযীদ (রাঃ)-কে জানানো হয়েছে যে, ওমর (রাঃ) উবাই ও তামীম আদ-দারীর মাধ্যমে লােকদের একত্রিত করেন। অতঃপর তারা উভয়ে ১১ রাক’আত ছালাত আদায় করান।
মুহাম্মাদ ইবনু আবী শায়বা আল-কুফী, আল-মুসান্নাফ (বৈরুত: দারুল ফিকর, ১৯৮৯/১৪০৯ হিঃ), ২/২৮৪ পৃঃ, হা/৭৭২৭, রামাযান মাসে রাতের সালাত অনুচ্ছেদ।
হাদীছটি সম্পর্কে আল্লামা ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী (রহঃ) বলেন, হাদিসটির সনদ ছহীহ।
মুহাদ্দিসগণের পক্ষ থেকে সহীহ বলে স্বীকৃত উক্ত হাদীস দ্বয়ের মাধ্যমে প্রতীয়মান হয় যে, দ্বিতীয় খলিফা ওমর (রাঃ) রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সালাতের ন্যায় ১১ রাকাত তারাবিহ পড়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
এক্ষণে আমরা জানব, ওমর (রাঃ)-এর যুগে কত রাকআত তারাবীহ পড়া হত।
মুহাম্মদ ইবনু ইউসুফ (রাঃ) বলেন,
আমি সায়িব ইবনু ইয়াযীদ (রাঃ)-কে বলতে শুনেছি তিনি বলেছেন, আমরা ওমর (রাঃ)-এর যামানায় ১১ রাকাত সালাত আদায় করতাম।
সাঈদ ইবনু মানছুর, আস-সুনান, আওনুল মাবুদ ৪/১৭৫, হা/১৩৭২-এর আলােচনা দ্রঃ।
হাদিসটির সনদ সম্পর্কে শায়খ আলবানী ও আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূতী (৮৪৯৯১১ হিঃ) বলেন, হাদিসটির সনদ ছহীহ পর্যায়ভুক্ত।
সায়িব ইবনু ইয়াযীদ (রাঃ) বলেন,
আমরা ওমর (রাঃ)-এর যামানায় রামাযান মাসে ১৩। রাকাত সালাত পড়তাম।
মুহাম্মাদ ইবনু নাছর, কিয়ামুল লাইল; ফাৎহুল বারী ৪/৩১৯ পৃঃ।
উক্ত বর্ণনাতে ফজরের দুই রাকাত সুন্নত সহ বর্ণিত হয়েছে; আয়েশা (রাঃ)-এর হাদীছের সাথে সামঞ্জস্য রয়েছে যেখানে ফজরের দুই রাকাত সুন্নত সহ এসেছে; সেই সাথে ইমাম মালেক বর্ণিত ওমর (রাঃ)-এর নির্দেশিত ১১ রাকআতের হাদীসের সাথেও মিল রয়েছে।
তাই আল্লামা নীমভী হানাফী এ সম্পর্কে বলেন,
ইমাম মালেক মুহাম্মাদ ইবনু ইউসুফ থেকে যা বর্ণনা করেছেন, এ হাদীসটি তার অতীব নিকটবর্তী অর্থাৎ সহীহ।
ইবনে হাজার আসকালানী বলেন, হাদীছটি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর রাত্রির সালাতের ব্যাপারে বর্ণিত মা আয়েশা (রাঃ)-এর হাদীসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
ইবনে ইসহাক বলেন, তারাবীর সালাত সম্পর্কে আমি যা শুনেছি তার মধ্যে এটিই সর্বাধিক বলিষ্ঠ বর্ণনা।
আমরা এতক্ষণ আট বা এগারো রাকাতের পক্ষে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সাহাবীগণ এবং তাদের যুগ পর্যন্ত যে হাদীসগুলো পেশ করলাম তার সবগুলোই সহীহ। রিজাল শাস্ত্র বিদগণ এবং বিশ্ব বিখ্যাত মুহাদ্দিস গণের বলিষ্ঠ উক্তির মাধ্যমে যা প্রমাণিত হয়েছে।
শায়খ আলবানী ১১ রাকাত সংক্রান্ত রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও ছাহাবায়ে কেরামের আমল বিশ্লেষণ করার পর মুসলিম উম্মাহর জন্য রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অবিস্মরণীয় ভাষণ সামনে রেখে বলেন,
উপরিউক্ত আলোচনাগুলো আমাদের জন্য সঠিক পথ উন্মোচন করেছে; তাই আমরা অবশ্যই বলব যে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বক্তব্যের আনুগত্য করণার্থে নির্দিষ্ট সংখ্যা (১১ রাকাত)-কে আঁকড়ে ধরা এবং এর অতিরিক্ত সংখ্যা পরিত্যাগ করা ওয়াজিব।
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বক্তব্য হল, নিশ্চয়ই আমার পরে তােমাদের মধ্যে যারা বেঁচে থাকবে তারা অতি সত্বর অসংখ্য মতপার্থক্য দেখতে পাবে। সে সময় তােমাদের অপরিহার্য কর্তব্য হবে আমার সুন্নাত এবং অভ্রান্ত পথ প্রাপ্ত খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরা এবং দাঁত দ্বারা কামড়ে ধরা। আর (শরীয়তের মধ্যে) তোমরা নতুন সৃষ্ট বিষয়সমূহ থেকে সাবধান থাকবে। কারণ নতুন সৃষ্ট বস্তুই বিদআত এবং প্রত্যেক বিদআতি পথভ্রষ্ট, আর প্রত্যেক পথভ্রষ্টই জাহান্নামী।
আশা করি হাদীছটি শতধা বিভক্ত মুসলিম উম্মাহর জন্য ঐক্যের প্রতীক বিবেচিত হবে, হবে সঠিক পথের দিশারী। কারণ সহীহ বর্ণনার মাধ্যমে রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কোন আমল প্রমাণিত হলে এর বিপরীত যে আমলই সমাজে প্রচলিত থাক না কেন তা বাতিল বলে গণ্য হবে। চাই তা কোন ইমামের বক্তব্য হোক, বা কোন মনীষী, আলেম, মুজতাহিদ, ফকীহ এর বক্তব্য হোক কিংবা যঈফ ও জাল হাদীছ হোক সর্বাবস্থায় তা বাতিল সাব্যস্ত হবে।
তারাবির নামাজ কত রাকাত, তারাবি নামাজ কত রাকাত, তারাবির নামাজ ৮ না ২০ রাকাত, তারাবীহ নামাজ কয় রাকাত, তারাবির নামাজ কয় রাকাত, তারাবির নামাজ ২০ রাকাত, তারাবি কত রাকাত, ২০ রাকাত তারাবির দলিল, তারাবির নামায কত রাকাত, তারাবিহ কত রাকাত, তারাবির নামাজ কয় রাকাত, তারাবীহ ২০ রাকাতের দলিল, তারাবীর রাকাত সংখ্যা, তারাবীর নামাজ ৮ রাকাত, তারাবীর নামাজ কত রাকাত, তারাবীহ নামাজ কত রাকাত, তারাবীহ কত রাকাত, তারাবীহ ৮ রাকাত না ২০ রাকাত, তারাবির নামাজ কত রাকাত সহীহ হাদিস, তারাবির নামাজের রাকাত সংখ্যা, তারাবির নামাজ ৮ রাকাতের দলিল, tarabi namaz koto rakat, tarabi namaz rakat, taraweeh rakat,
আলহামদু লিল্লাহ।.
আলেমদের ইজতিহাদনির্ভর মাসয়ালাগুলো নিয়ে কোন মুসলিমের সংবেদনশীল আচরণ করাকে আমরা সমীচীন মনে করি না। যে আচরণের কারণে মুসলমানদের মাঝে বিভেদ ও ফিতনা সৃষ্টি হয়।
শাইখ ইবনে উছাইমীন রহিমাহুল্লাহকে এমন ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয় যিনি ইমামের সাথে ১০ রাকাত তারাবী নামায পড়ে বিতিরের নামাযের অপেক্ষায় বসে থাকেন, ইমামের সাথে অবশিষ্ট তারাবী নামায পড়েন না, তখন তিনি বলেন:
“এটি খুবই দুঃখজনক যে, আমরা মুসলিম উম্মাহর মধ্যে এমন একটি দল দেখি যারা ভিন্ন মতের সুযোগ আছে এমন বিষয় নিয়ে বিভেদ সৃষ্টি করেন। এই ভিন্ন মতকে তারা অন্তরগুলোর বিচ্ছেদের কারণ বানিয়ে ফেলেন। সাহাবীদের সময়েও এই উম্মতের মাঝে মতভেদ ছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁদের অন্তরগুলো ছিল ঐক্যবদ্ধ। তাই দ্বীনদারদের কর্তব্য, বিশেষভাবে যুব-সমাজের কর্তব্য হচ্ছে- ঐক্যবদ্ধ থাকা। কারণ শত্রুরা তাদেরকে নানারকম ফাঁদে ফেলানোর জন্য ওঁত পেতে বসে আছে।”[আশ-শারহুল মুমতি‘ (৪২২৫)]
এই মাসয়ালার ব্যাপারে দুই পক্ষই অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করে। প্রথম পক্ষের লোকেরা যারা ১১ রাকাতের বেশি তারাবী পড়েন তাদের আমলকে একেবারে অস্বীকার করে এ আমলকে বিদআত আখ্যায়িত করেন। আর দ্বিতীয় পক্ষের লোকেরা যারা শুধু ১১ রাকাতে সীমাবদ্ধ থাকেন তাদের আমলকে অস্বীকার করে বলেন: তারা ইজমা‘ এর খেলাফ করছে।
চলুন আমরা এ ব্যাপারে শাইখ ইবনে উছাইমীন রহিমাহুল্লাহ এর উপদেশ শুনি, বলেন:
“এ ক্ষেত্রে আমরা বলব: বাড়াবাড়ি বা শিথিলতা কোনটাই উচিত নয়। কেউ কেউ আছেন সুন্নাহ্ তে বর্ণিত সংখ্যা মানার ব্যাপারে কড়াকড়ি আরোপ করেন এবং বলেন: সুন্নাহ্ তে যে সংখ্যার বর্ণনা এসেছে তা থেকে বাড়ানো নাজায়েয। যে ব্যক্তি সে সংখ্যার বেশী তারাবী পড়ে তার কঠোর বিরোধিতা করেন এবং বলেন যে, সে গুনাহগার ও সীমালঙ্ঘণকারী।
এই দৃষ্টিভঙ্গি যে ভুল এতে কোন সন্দেহ নেই। কিভাবে সে ব্যক্তি গুনাহগার বা সীমালঙ্ঘণকারী হবে যেখানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রাতের সালাত (কিয়ামুল লাইল) সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেছিলেন:“দুই রাকাত দুই রাকাত।” তিনি তো কোন সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দেননি। এ কথা সবারই জানা আছে যে,যেই সাহাবী রাতের সালাত সম্পর্কে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে প্রশ্ন করেছিলেন, তিনি রাতের নামাযের সংখ্যা জানতেন না। কারণ যিনি সালাতের পদ্ধতিই জানেন না,রাকাত সংখ্যা সম্পর্কে তার না-জানবারই কথা। আর তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সেবকও ছিলেন না যে আমরা এ কথা বলব- তিনি রাসূলের বাসার ভিতরের আমল কি সেটা জানতেন। যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেই সাহাবীকে কোন সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দেননি, শুধু সালাতের পদ্ধতি বর্ণনা করেছেন,এতে জানা গেল যে, এ বিষয়টি উন্মুক্ত। সুতরাং যে কেউ ইচ্ছা করলে ১০০ রাকাত তারাবীর নামায ও ১ রাকাত বিতির নামায আদায় করতে পারেন।
আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-বাণী :
صلوا كما رأيتموني أصلي
“তোমরা আমাকে যেভাবে সালাত আদায় করতে দেখলে সেভাবে সালাত আদায় কর।”
এই হাদিসটির বিধান সাধারণ নয়; এমনকি এ মতাবলম্বীদের নিকটও নয়। তাই তো তারা কোন ব্যক্তির উপর একবার ৫ রাকাত,একবার ৭ রাকাত, অন্যবার ৯ রাকাত বিতির আদায় করা ওয়াজিব বলেন না। আমরা যদি এ হাদিসকে সাধারণভাবে গ্রহণ করি তাহলে আমাদেরকে বলতে হবে যে বিতিরের নামায কোনবার ৫ রাকাত, কোনবার ৭ রাকাত এবং কোনবার ৯ রাকাত আদায় করা ওয়াজিব। বরং “তোমরা আমাকে যেভাবে সালাত আদায় করতে দেখলে সেভাবে সালাত আদায় কর”-এ হাদিস দ্বারা সালাত আদায়ের পদ্ধতি বুঝানো উদ্দেশ্য; সালাতের রাকাত সংখ্যা নয়। তবে রাকাত সংখ্যা নির্দিষ্ট করে এমন অন্য কোন দলীল পাওয়া গেলে সেটা ভিন্ন কথা।
যাই হোক, যে বিষয়ে শরিয়তে প্রশস্ততা আছে সে বিষয়ে কারো উপর চাপ প্রয়োগ করা উচিত নয়। ব্যাপারটি এ পর্যন্ত গড়িয়েছে যে, আমরা দেখেছি কিছু ভাই এ বিষয়টি নিয়ে এত বেশি বাড়াবাড়ি করেন যে, যেসব ইমাম ১১ রাকাতের বেশি তারাবী নামায পড়েন এরা তাদের উপর বিদআতের অপবাদ দেন এবং (১১ রাকাতের পর) মসজিদ ত্যাগ করেন। এতে করে তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বর্ণিত সওয়াব থেকে বঞ্চিত হন। তিনি বলেছেন: “ইমাম নামায শেষ করা পর্যন্ত যে ব্যক্তি ইমামের সাথে কিয়ামুল লাইল (রাতের নামায) পড়বে তার জন্য সম্পূর্ণ রাতে নামায পড়ার সওয়াব লেখা হবে।”[হাদিসটি বর্ণনা করেছেন তিরমিযি (৮০৬) এবং ‘সহীহুত তিরমিযি গ্রন্থে (৬৪৬)আলবানী হাদিসটিকে সহীহ্ আখ্যায়িত করেছেন] এ শ্রেণীর লোকদের মধ্যে অনেকে ১০ রাকাত বিতির আদায় করে বসে থাকে; ফলে কাতার ভঙ্গ হয়। আবার কখনও তারা কথাবার্তা বলে; যার ফলে মুসল্লিদের সালাতে অসুবিধা হয়।
আমরা এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ পোষণ করছি না যে তাঁরা ভাল চাচ্ছেন এবং এক্ষেত্রে তাঁরা মুজতাহিদ; কিন্তু সব মুজতাহিদ সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছেন না।
আর দ্বিতীয় পক্ষটি প্রথম পক্ষের সম্পূর্ণ বিপরীত। যারা ১১ রাকাতের মধ্যে তারাবীকে সীমাবদ্ধ রাখতে চান— এরা তাদের কঠোর বিরোধিতা করেন এবং বলেন যে, তুমি ইজমা থেকে বের হয়ে গেছ। অথচ আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন: “আর যে তার কাছে সত্য প্রকাশিত হওয়ার পর রাসূলের বিরোধিতা করে এবং মুমিনদের পথের বিপরীত পথ অনুসরণ করে আমি তাকে সেদিকে পরিচালিত করব যে দিকে সে অভিমুখী হয় এবং আমি তাকে প্রবেশ করাব জাহান্নামে। আর তা কতই না খারাপ প্রর্ত্যাবর্তন।”[সূরা আন-নিসা, ৪:১১৫]
তারা বলেন যে, আপনার আগে যারা অতিবাহিত হয়েছেন তাঁরা শুধু ২৩ রাকাত তারাবীই জানতেন। এরপর তারা বিপক্ষবাদীদের তীব্র বিরোধিতা শুরু করেন। এটাও ভুল।[আশশারহুল মুমতি (৩/৭৩-৭৫)]
যারা ৮ রাকাতের বেশি তারাবীর নামায পড়া নাজায়েয মনে করেন তারা যে দলীল দেন সেটা হলো আবু সালামাহ্ ইবনে আব্দুর রহমান এর হাদিস যাতে তিনি আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) কে প্রশ্ন করেছিলেন: “রমজানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সালাত কেমন ছিল? তিনি বললেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানে বা রমজানের বাইরে ১১ রাকাতের বেশি আদায় করতেন না। তিনি ৪ রাকাত সালাত আদায় করতেন- এর সৌন্দর্য ও দৈর্ঘ্য সম্পর্কে প্রশ্ন করবেন না (অর্থাৎ তা এতই সুন্দর ও দীর্ঘ হত)। এরপর তিনি আরো ৪ রাকাত সালাত আদায় করতেন-এর সৌন্দর্য ও দৈর্ঘ্য সম্পর্কে প্রশ্ন করবেন না (অর্থাৎ তা এতই সুন্দর ও দীর্ঘ হত)। এরপর তিনি ৩ রাকাত সালাত আদায় করতেন। আমি বলতাম: ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনি কি বিতির পড়ার আগে ঘুমিয়ে যাবেন?” তিনি বলতেন: “হে আয়েশা! আমার চোখ দুটি ঘুমালেও অন্তর ঘুমায় না।”[হাদিসটি বর্ণনা করেছেন ইমাম বুখারী (১৯০৯) ও ইমাম মুসলিম (৭৩৮)]
তারা বলেন: এই হাদিসটি নির্দেশ করছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানে ও রমজানের বাইরে রাতের বেলা নিয়মিত এভাবেই সালাত আদায় করতেন। আলেমগণ এ হাদিস দিয়ে দলীলের বিপক্ষে বলেন যে, এই হাদিসটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমল সাব্যস্ত করছে। কিন্তু কোন আমল দ্বারা তো ওয়াজিব সাব্যস্ত করা যায় না।
আর রাতের সালাত (এর মধ্যে তারাবীর নামাযও শামিল) যে কোন সংখ্যার মধ্যে সুনির্দিষ্ট নয় এ ব্যাপারে বর্ণিত স্পষ্ট দলীলগুলোর মধ্যে একটি হলো ইবনে উমর (রাঃ) এর হাদিস- “এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রাতের সালাত সম্পর্কে প্রশ্ন করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: “রাতের সালাত দুই রাকাত, দুই রাকাত। আপনাদের মধ্যে কেউ যদি ফজরের ওয়াক্ত হয়ে যাওয়ার আশংকা করেন তবে তিনি যেন আরো এক রাকাত নামায পড়ে নেন। যাতে করে এ রাকাতটি পূর্বে আদায়কৃত সংখ্যাকে বিতির (বেজোড়) করে দেয়।”[হাদিসটি বর্ণনা করেছেন,ইমাম বুখারী (৯৪৬)ও ইমাম মুসলিম (৭৪৯)]
বিভিন্ন গ্রহণযোগ্য ফিক্বহী মাজহাবের আলেমগণের মতামতের দিকে দৃষ্টি দিলে পরিষ্কার হয় যে, এ বিষয়ে প্রশস্ততা আছে। ১১ রাকাতের অধিক রাকাত তারাবী পড়তে দোষের কিছু নেই।
হানাফী মাজহাবের আলেম ইমাম আস্সারখাসী বলেন: “আমাদের মতে বিতির ছাড়া তারাবী ২০ রাকাত ।”[আল্মাবসুত (২/১৪৫)]
ইবনে ক্বুদামাহ বলেন: “আবু-আবদুল্লাহ অর্থাৎ ইমাম আহমাদ (রাহিমাহুল্লাহ) এর কাছে পছন্দনীয় মত হলো তারাবী ২০ রাকাত। এই মতে আরো রয়েছেন ইমাম ছাওরী, ইমাম আবু-হানীফা ও ইমাম শাফেয়ী। আর ইমাম মালেক বলেছেন: “তারবীহ ৩৬ রাকাত।”[আলমুগনী (১/৪৫৭)]
ইমাম নববী বলেছেন:
“আলেমগণের ইজমা অনুযায়ী তারাবীর সালাত পড়া সুন্নত। আর আমাদের মাজহাব হচ্ছে- তারাবীর নামায ১০ সালামে ২০ রাকাত। একাকী পড়াও জায়েয, জামাতের সাথে পড়াও জায়েয।”[আলমাজমূ (৪/৩১)]
এই হচ্ছে তারাবী নামাযের রাকাতের সংখ্যার ব্যাপারে চার মাজহাবের অভিমত। তাঁদের সবাই ১১ রাকাতের বেশী পড়ার ব্যাপারে বলেছেন। সম্ভবত যে কারণে তাঁরা ১১ রাকাতের বেশি পড়ার কথা বলেছেন সেটা হলো:
১.তাঁরা দেখেছেন যে, আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) এর হাদিস নির্দিষ্ট কোন সংখ্যা নির্ধারণ করে না।
২.পূর্ববর্তী সাহাবী ও তাবেয়ীগণের অনেকের কাছ থেকে ১১ রাকাতের বেশি তারাবী পড়ার বর্ণনা পাওয়া যায়।[আল-মুগনী (২/৬০৪)ও আল-মাজমূ (৪/৩২)]
৩.নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে ১১ রাকাত সালাত আদায় করতেন তা এত দীর্ঘ করতেন যে এতে পুরো রাত লেগে যেত। এমনও ঘটেছে এক রাতে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সাহাবীদেরকে নিয়ে তারাবীর সালাত আদায় করতে করতে ফজর হওয়ার অল্প কিছুক্ষণ আগে শেষ করেছিলেন। এমনকি সাহাবীগণ সেহেরী খেতে না-পারার আশঙ্কা করেছিলেন। সাহাবীগণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পিছনে সালাত আদায় করতে পছন্দ করতেন এবং এটা তাঁদের কাছে দীর্ঘ মনে হত না। কিন্তু আলেমগণ খেয়াল করলেন ইমাম যদি এভাবে দীর্ঘক্ষণ ধরে সালাত আদায় করেন তবে মুসল্লিদের জন্য তা কষ্টকর হবে। যা তাদেরকে তারাবীর নামায থেকে বিমুখ করতে পারে। তাই তাঁরা তেলাওয়াত সংক্ষিপ্ত করে রাকাত সংখ্যা বাড়ানোর পক্ষে মত দিলেন।
সার কথা হলো- যিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত পদ্ধতিতে ১১ রাকাত সালাত পড়েন সেটা ভাল এবং এতে সুন্নাহ পালন হয়। আর যিনি তেলাওয়াত সংক্ষিপ্ত করে রাকাতের সংখ্যা বাড়িয়ে পড়েন সেটাও ভাল। যিনি এই দুইটির কোন একটি করেন তাঁকে নিন্দা করার কিছু নেই।
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ বলেছেন:
“যিনি ইমাম আবু হানীফা শাফেয়ী ও আহমাদের মাজহাব অনুসারে ২০ রাকাত তারাবী সালাত আদায় করল অথবা ইমাম মালেকের মাজহাব অনুসারে ৩৬ রাকাত তারাবী আদায় করল অথবা ১৩ বা ১১ রাকাত তারাবী আদায় করল প্রত্যেকেই ভাল আমল করল। এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট নির্দেশনা না থাকার কারণে ইমাম আহমাদ এ মতই পোষণ করতেন। তাই তেলাওয়াত দীর্ঘ বা সংক্ষিপ্ত করার অনুপাত অনুযায়ী রাকাত সংখ্যা বেশি বা কম হবে।”[আল-ইখতিয়ারাত, পৃষ্ঠা- ৬৪]
আস-সুয়ুতী বলেছেন:
“রমজানে ক্বিয়াম তথা রাতের নামায আদায় করার আদেশ দিয়ে ও এ ব্যাপারে উৎসাহিত করে অনেক সহীহ ও হাসান হাদিস বর্ণিত হয়েছে। এক্ষেত্রে কোন সংখ্যাকে সুনির্দিষ্ট করা হয়নি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ২০ রাকাত তারাবী পড়েছেন বলে সাব্যস্ত হয়নি। বরং তিনি রাতে সালাত আদায় করেছেন। কিন্তু কত রাকাত আদায় করেছেন এই সংখ্যা উল্লেখিত হয়নি। এরপর ৪র্থ রাতে দেরি করলেন এই আশঙ্কায় যে তারাবীর সালাত তাঁদের উপর ফরয করে দেয়া হতে পারে, পরে তাঁর উম্মত তা পালন করতে অসমর্থ হবেন।”
ইবনে হাজার হাইসামী বলেছেন:
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ থেকে তারাবীর সালাত ২০ রাকাত হওয়ার ব্যাপারে কোন সহীহ বর্ণনা পাওয়া যায়নি। আর এই ব্যাপারে যা বর্ণিত হয়েছে- “তিনি ২০ রাকাত সালাত আদায় করতেন; তা অত্যন্ত জয়ীফ (দুর্বল)।”[আল্মাওসূ‘আহ আল-ফিক্বহিয়্যাহ (২৭/১৪২-১৪৫)]
অতএব প্রশ্নকারী ভাই, আপনি তারাবীর সালাত ২০ রাকাত হওয়ার ব্যাপারে অবাক হবেন না। কারণ এর আগে ইমামগণ প্রজন্মের পর প্রজন্ম তা পালন করেছেন। আর তাঁদের সবার মধ্যেই কল্যাণ রয়েছে।
আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন।